Library

রঘুবীর ও তপোবনের সন্ধানে

আমাদের বাংলার নরম পলি মাটিতে শ্রী রামচন্দ্র রাজবেশ ছেড়ে অনেকটাই মাটির কাছাকাছি ভক্তের হৃদয়ে ভক্তিভাবে পূজিত হন। বাংলার কোথাও কোথাও তিনি রঘুবীর, আবার কোথাও তিনি রঘুনাথ, আবার কোথাও ভক্তের একান্ত আপন পরমস্নেহের রামলালা। বাংলার বুকে শ্রীরামচন্দ্রের প্রেমময় স্বরূপটি সেই যে মধ্যযুগে ফুলিয়া নিবাসী কৃত্তিবাস ওঝা শ্রীরাম পাঁচালী তে স্বর্ণাক্ষরে এঁকেছেন, সেই বাঙালী রামচন্দ্রই সারা বাংলার বিভিন্নস্থানে পূজিত হন। বীররস নয়,প্রেম-ভক্তিরসেরই প্রাধাণ্য। দশরথ নন্দন বীরশ্রেষ্ঠ রামচন্দ্রের থেকেও জানকী পতি রামচন্দ্রের প্রভাব এই অঞ্চলে বেশি। সাথে প্রিয় ভ্রাতা লক্ষ্মণ ও পূজা পান। ভগবান বাংলার মাটির গুণে সংসারী, সাধারণ মানুষের মতোই তার নিত্যচাহিদা। সপরিবারে ভক্তের মন্দিরে তাঁর অধিষ্ঠান। 

  পশ্চিম মেদিনীপুরের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে থাকা শ্রীরামচন্দ্রের মন্দির দেখতে গিয়ে সত্যিই চমকে গিয়েছিলাম। গভীর জঙ্গলের মধ্যে বাল্মীকির আশ্রম, লব-কুশের জন্মস্থানও যেমন আছে, তেমনই, শহরের মধ্যে শতাব্দী প্রাচীন ভগ্ন রঘুনাথজিউ মন্দির, সরযূ, অযোধ্যাও আছে। সাথে রামানন্দ এবং রামানুজ শ্রী সম্প্রদায়ের অস্থল-মঠও নিজ ঐতিহ্যে ভাস্বর। চলুন, একে একে আমরা পরিক্রমা শুরু করি পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় শ্রীরামচন্দ্রের খাসতালুকের সন্ধানে।

চন্দ্রকোণা ও পাশাপাশি অঞ্চলের শ্রী রঘুনাথজীউ—

বাহান্ন বাজার তিপান্ন গলি,

তবে জানলি তুই চন্দ্রকোণা এলি।

লোকমুখে প্রচলিত এই ছাড়াতেই বোঝা যায় চন্দ্রকোণা শহরটি এককালে বেশ সমৃদ্ধশালী ছিল। প্রাচীন ও মধ্যযুগে চন্দ্রকোণা নগর মল্ল, কেতু এবং ভান রাজাদের দ্বারা শাসিত হয়েছিল। বহু পুরোনো লোককথা অনুসারে,  শ্রীরাম চন্দ্র বৈকুন্ঠ যাত্রার পূর্বে ভরতকে আদেশ করেন কুমারগন কে বিভিন্ন রাজ্যে অভিষিক্ত করার জন্য। লক্ষণ পুত্র চন্দ্রকেতু মল্লভূমের অন্তর্গত চন্দ্রকান্তা নগরে অভিষিক্ত হন। এই চন্দ্রকান্তা পুরীই বর্তমানের চন্দ্রকোণা।

  শৈব মল্লবংশের শেষ নৃপতি ছিলেন খয়ের মল্ল। বিখ্যাত মল্লেশ্বর শিব মন্দির তিনি প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি রাজপুতবীর চন্দ্রকেতুর কাছে পরাজিত হয়ে চন্দ্রকোণা অঞ্চল থেকে বিষ্ণুপুরে পলায়ন করেন এবং বিষ্ণুপরে রাজত্ব ও রাজধানী প্রতিষ্ঠা করেন। মৃগাঙ্ক নাথ রায় ‘চন্দ্রকোণার ইতিবৃত্ত’  নামক গ্রন্থে সপ্তম শতাব্দী তে চন্দ্রকেতু কর্তৃক চন্দ্রকোণা নগরী প্রতিষ্ঠিত হয় বলে মত প্রকাশ করেছেন। তবে এই ব্যাপারে ভিন্ন মতও আছে।

বিশিষ্ট গবেষক এবং ‘মেদিনীপুর’ গ্রন্থের প্রণেতা তরুন দেব ভট্টাচার্য্য, যোগেশ চন্দ্র  বসু প্রভৃতির মতে কেতুবংশের আদি পুরুষ ইন্দ্রকেতু।তিনি পঞ্চদশ শতকে আনন্দপুরকে কেন্দ্র করে চন্দ্রকোণাসহ বিস্তীর্ণ এলাকা নিজ দখলে আনেন, তাঁর পুত্র নরেন্দ্র কেতুরও রাজধানী ছিল আনন্দপুর। নরেন্দ্র কেতু পুত্র চন্দ্রকেতু চন্দ্রকোণাতে রাজধানী স্থাপন করেন। চন্দ্রকোণা নগরে গড়,মন্দির প্রতিষ্ঠা এই চন্দ্রকেতুর আমলেই।বিখ্যাত রামগড় ও লালগড় তারই আমলে নির্মিত। রামগড় দূর্গে রঘুনাথজীউ অধিষ্ঠান করতেন এবং লালগড়ে লালজীউ। শ্রীরাম চন্দ্র রঘুনাথজীউ রূপে এবং নারায়ণ লালজীউ রূপে কেতু রাজ বংশে দীর্ঘকাল পূজা পেয়ে এসেছেন। তবে পরবর্তী কালে ভান রাজারা কেতু বংশ উচ্ছেদ করে ভান বংশ প্রতিষ্ঠা করেন। এবং তারও পরে বর্ধমান রাজা কীর্ত্তিচাঁদের সাথে চন্দ্রকোণার যুদ্ধে রামগড় এবং লালগড় দূর্গ দুটি বিধ্বস্ত হয় এবং দূর্গমধ্যস্থ রঘুনাথ জীউ ও লালজীউ মন্দির দুটি বিনষ্ট হয়। বর্ধমানরাজা রাঘুনাথজীউ ও লালজীউকে নিয়ে বর্ধমানে মন্দির প্রতিষ্ঠার মানসে বর্ধমানে ফেরার পথ ধরেন। চন্দ্রকোণার সীমানায় রাতে তাঁবু ফেলা হয়, গভীর ঘুমের মধ্যে রাজা কীর্তিচাঁদ স্বপ্ন দেখেন সাক্ষাৎ রঘুনাথ কে। রঘুনাথজীউ চন্দ্রকোণা থেকে কোথাও যেতে চান না, রাজাকে তিনি আদেশ করেন চন্দ্রকোণাতেই তাঁরা থাকার মন্দির তৈরী করে দিতে। আর  নিত্য রঘুনাথজীউ দর্শনের  জন্য গলার গজমতির মালাটি রাজা  সাথে করে নিয়ে যাওয়ার অনুমতি পান। পরের দিন প্রভাতেই রাজা আদেশ দেন চন্দ্রকোণাতে রঘুনাথজীউর  নতুন মন্দির  তৈরীর। সরাবছরের পূজা-পার্বনের খরচ পত্র সেই সময় থেকে বর্ধমান রাজাদের দ্বারাই সম্পন্ন হতে থাকে। রামগড় ও লালগড়ের মাঝে সরযূ নদীর তীরে নির্মিত হয় তিনটি মন্দির। দুটি রঘুনাথের(দেউল এবং জগমোহন)এবং তার-ই পাশে একটি লালজীউর।

 বর্ধমান রাজা প্রতিষ্ঠা করেন অযোধ্যা নামে একটি গ্রাম, ছোট্ট নদীর নামকরণ হয় সরযূ। পুরীর জগন্নাথ দেবের মন্দিরের আদলে তৈরী হয় রঘুনাথজীউ মন্দির। মন্দির গাত্রে অপূর্ব কিন্নর-কিন্নরী মূর্তি। মন্দিরে প্রতিষ্ঠা হয় রঘুনাথজীউ, সীতাদেবী, অঙ্গদ, নল, জাম্বুবান, নারায়ণ শিলা। মন্দিরের সামনের দিকের প্রাচীর ছাড়িয়ে দেখা যায় মহাবীর হনুমান মন্দির, জীর্ণ নাটমন্দির, চারচালা যুক্ত তোষাখানা, রাসমঞ্চ, ভোগঘর, অতিথিশালা, ঝুলন মন্দির ইত্যাদি। তবে সবই ভগ্ন দশা প্রাপ্ত। 

  রঘুনাথ মন্দিরে বর্তমানে কোন বিগ্রহ নেই, মন্দিরের একেবারে ভগ্নদশার কারণে বিগ্রহ সকল ঠাকুরবাড়ী বাজারে নব নির্মিত একটি মন্দিরে রাখা হয়েছে। সেখানেই রঘুনাথজীউ, মা সীতা নিত্যপূজা পান। বর্তমানে অযোধ্যাররঘুনাথজীউ মন্দিরের স্থানে শুধুই পোড়া ইটের এবং মকড়া পাথরের তৈরী মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ। 

পুরোনো রঘুনাথ মন্দিরের উল্টোদিকে দক্ষিণমুখী লালজীউ মন্দির। এই মন্দির থেকে প্রাপ্ত শিলালিপি বর্তমানে ঠাকুরবাড়ি সংগ্রহশালায় সংরক্ষিত আছে। শিলালিপি থেকে জানা যায়,লালজীউ এবং রঘুনাথ জীউ মন্দির ১৫৭৭ শকাব্দে মন্দির নির্মান কাজ ভান রাজ বংশোদ্ভূত রাজা বীরভানের আমলে শুরু হয় ও মিত্রসেনের আমলে নির্মান সম্পন্ন হয়। ঐতিহাসিক মেদিনীপুর বিশেষজ্ঞ যোগেশ চন্দ্র বসুর মতে শিলালিপি অনুসারে ১৫৭৭ শকাব্দে নির্মিত মন্দির দুটির কোনোটিই বর্তমানে যে ধ্বংসাবশেষ দেখা যায় সেই  মন্দির গুলি নয়। অতীতে রামগড় ও লালগড় দূর্গ মধ্যস্থ মন্দির গুলির কথাই শিলালিপিতে উল্লিখিত আছে।

  প্রাচীনতার দিক থেকে দেখতে গেলে চন্দ্রকোণার রঘুনাথজীউ বাংলার বুকে পূজিত অন্যতম ঐতিহাসিক শ্রীরামচন্দ্র। প্রতি বছর আষাঢ় মাসে রঘুনাথজীউর রথযাত্রা হয় স্থানীয় ঠাকুরবাড়ির বাজারে। পৌষমাসে পুষ্যানক্ষত্রযুক্ত পূর্নিমাতে ভগবান রঘুনাথের পুষ্যাভিষেক যাত্রা এবং উৎসব সেই অতীত থেকে  এখনও পর্যন্ত ধুমধাম সহ উদযাপিত হয়।

রামানুজ শ্রী সম্প্রদায়ের অস্থল-মঠ,রামানন্দপন্থী লস্করীমঠ,অযোধ্যা গ্রাম ও সরযূ নদী—

বৈষ্ণবধর্ম অবলম্বীগণ মূলত চারটি প্রধান উপশাখায় বিভক্ত। এই উপশাখাগুলোকে বলা হয় সম্প্রদায়। এদের মধ্যে –

লক্ষ্মী সম্প্রদায়, যা আচার্য রামানুজের দ্বারা প্রচারিত দর্শনভিত্তিক বিশিষ্টাদ্বৈত মতবাদের উপর প্রতিষ্ঠিত। দক্ষিন ভারতে এরা শ্রী সম্প্রদায় নামে জনপ্রিয়।

  ব্রহ্মা সম্প্রদায়, যা মাধবাচার্য প্রচারিত দ্বৈত এবং চৈতন্য মহাপ্রভু দ্বারা প্রচারিত অচিন্ত্য ভেদ অভেদ মতবাদ। আমাদের বাংলার গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্ম এই সম্প্রদায়ের অন্তর্ভূক্ত।

  রুদ্র সম্প্রদায়, যা বিষ্ণুস্বামী ও বল্লভ আচার্য দ্বারা প্রচারিত শুদ্ধাদ্বৈত মতবাদ ও নিম্বার্ক সম্প্রদায়, আচার্য নিম্বার্কের দ্বারা প্রচারিত দ্বৈতাদ্বৈত মতবাদ।

  আচার্য্য শ্রী রামানুজ বিশিষ্ঠাদ্বৈত মতে ভক্তিবাদ প্রচার করেন। এই সম্প্রদায়ের অনেকেই রাম ও সীতার যুগল মূর্তির উপাসনা  করেন, আবার অনেকে লক্ষ্মী -নারায়ণের উপাসক। রামানুজ সম্প্রদায় থেকে উদ্ভুত  রামানন্দী, রামায়েৎ সম্প্রদায়ে শ্রী রাম -সীতার উপাসনা প্রবল ভাবে প্রচলিত। রামানুজ সম্প্রদায়ে দেবী লক্ষ্মী সর্ব উচ্চ স্থানে অসীন। এই কারনে এই সম্প্রদায়কে শ্রী সম্প্রদায় নামেও অভিহিত করা হয়।

  চন্দ্রকোণার আনাচে কানাচে এই তিনটি বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের মঠ বহু কাল থেকে প্রতিষ্ঠিত। আমরা আজ শ্রী সম্প্রদায়ের চন্দ্রকোণাস্থিত মঠ বা অস্থল সম্পর্কে আলোচনা করব।

স্বরূপ রামানুজ দাস প্রায় পাঁচশ বছর পূর্বে শ্রীরঙ্গম  মূল গদি থেকে শ্রী সম্প্রদায়ের প্রচারে তৎকালীণ সমৃদ্ধশালী নগর চন্দ্রকোণায় আসেন। তখন চন্দ্রকোণায় শাক্ত, বৌদ্ধ ও জৈনধর্মের প্রভাব।  চন্দ্রকোণার রাজা নব্বই বিঘা ভূ সম্পত্তি দান করেন। চন্দ্রকোণারাজের অনুরোধে বিখ্যাত রঘুনাথ গড়ের সন্নিকটে নয়াগঞ্জে প্রতিষ্ঠা হয় মঠ, যা বড় অস্থল নামে পরিচিত। অস্থল প্রতিষ্ঠার জন্মলগ্ন থেকেই অস্থলে তিনটি প্রস্তর প্রোথিত। কর্ম, ভক্তি এবং জ্ঞান। এই তিনটি প্রস্তরের উদ্দেশ্য হল, কর্ম করলে তবে মানবের ভক্তি ভাবের উদ্রেক হয়। এই ভক্তি থেকেই জ্ঞান বিকাশ সম্ভব।

মূল মন্দিরে শ্রী শ্রী রঘুনাথ, শ্রীশ্রী গোপীনাথ এবং আরও বহু শ্রী বিগ্রহ পূজিত হয়। মূল মন্দিরের সন্নিকটে নাটমন্দির, গোশালা, মহাবীর মন্দির বর্তমানে ভগ্নদশাপ্রাপ্ত। পূর্বে গোশালাতে শতাধিক গাভী থাকত।

অস্থলের লক্ষ্মী খামারে এতো শস্য মজুত থাকত যে, মেদিনীপুর জেলায় দুই বৎসর দুর্ভিক্ষ হলেও খাদ্যাভাব হতো না। ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের সময় এই শস্য ভাণ্ডার জনসাধারণের  জন্য খুলে দেওয়া হয়েছিল। এই অস্থলের বিখ্যাত সাধু ভরত রামানুজ দাস মোহন্ত বহু বছর চন্দ্রকোণা পৌরসভার পৌরপিতার কাজ সুনামের সাথে করেছেন।

  অস্থলের নিজস্ব একটি গ্রন্থাগার আছে। স্বধামগত মোহন্ত-মহারাজ এবং সাধুদের রচিত ভূর্জপত্র ও তুলট কাগজের বহু প্রাচীন পুথি এখানে সংরক্ষিত। রামকুন্ড ও সীতাকুন্ড নামে দুটি বিশাল পুষ্করিণী ও কৃষিক্ষেত্র মঠের নিকটেই। রামকুন্ডের পূর্বপাড়ে মোহন্তদের সমাধি মন্দির। মোহন্তনিবাসের জন্য কুটীরের পেছনেই আগে লক্ষ্মী খামার ছিল, বর্তমানে তা বিশাল বাগন।

  এই প্রাচীন অস্থলটির পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে অনেকগুলি শাখা ছিল, বর্তমানে ও কয়েকটি আছে। কেশপুর থানার অন্তর্গত  ব্রাহ্মণভূমের শ্যামচাঁদপুরে ধনাঢ্য ধর্মপ্রান ব্যাক্তি নিত্যানন্দ সিংহ প্রতিষ্ঠিত  শ্রী রামচন্দ্র মন্দির এমনই একটি শাখা। এই মন্দিরটিতে শ্রীরামচন্দ্র, সীতা মা এবং লক্ষ্মণের শ্রীবিগ্রহ নিত্য পূজিত হয়। মন্দির নির্মানের পেছনে ছোট্ট একটি গল্প আছে। নিত্যানন্দ সিংহের একমাত্র পুত্রের অকালে প্রয়াণ ঘটলে শোকাতুর নিত্যানন্দ শোকে পাথর হয়ে যায়। সেই সময় নিত্যানন্দ তার এক বন্ধুর পরামর্শে চন্দ্রকোণাস্থিত বড় অস্থলে সেই সময়কার মঠাধীশ লছমন মহারাজের শরণাগত হন। প্রথম দর্শনে মহারাজ নিত্যানন্দকে জিজ্ঞেস করেন,

— ক্যায়া নিত্যানন্দ, তেরা বেটা গুজর গ্যায়া?

নিত্যানন্দ,তোমার ছেলে মারা গেছে?

নিত্যানন্দ উত্তর দেন, জী মহারাজ।

হ্যা মহারাজ।

মহারাজ বলেন, সোচ্ মত। এইসা ল্যাড়কা বনায়ে জো কভি নেহি মরে। অর্থাৎ  এই ছেলের জন্ম দাও যে কোন দিন মরবে না।

এরপরেই শ্যামচাঁদপুর গ্রামে ফিরে নিত্যানন্দ রঘুনাথজীউ মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। নিত্যানন্দের স্ত্রী সূর্যমণি দেবী পুত্র স্নেহে রঘুনাথ সেবায় আত্মনিয়োগ করেন। প্রতিষ্ঠা করা হয় শ্রীরাম চন্দ্র, সীতা এবং ভ্রাতা লক্ষ্মণের শ্রী বিগ্রহ। বর্তমানেও এই মন্দিরটি আছে, শ্রী রামচন্দ্রের রথ যাত্রা উৎসব এই অঞ্চলের সুবিখ্যাত। 

চন্দ্রকোণার মেজ অস্থলটিও বড় অস্থলের শাখা। বড় অস্থলের বিখ্যাত মোহন্ত লছমন মহারাজের সুযোগ্য শিষ্য দামোদর দাস মোহন্ত এই মেজ অস্থলের প্রতিষ্ঠাতা। এখানে রঘুনাথজীউ এবং রাধাবঙ্কু বিহারীর শ্রী বিগ্রহ পরম নিষ্ঠার সাথে পূজিত হয়।

ছোট অস্থলটি মুড়াকাটার ব্রহ্ম অস্থল।

চন্দ্রকেণার নিকটবর্তী আর এক বর্ধিষ্ণু অঞ্চল হল নাড়াজোল। এই নাড়াজোলের লঙ্কাগড় রাজ বংশ প্রতিষ্ঠিত শ্রীরামচন্দ্রের প্রাচীন মন্দির এবং রথ যাত্রা উৎসব সুবিখ্যাত।

রাজা জমিদারদের এবং বিখ্যাত সব সম্প্রদায়ের  ইতিহাস বিখ্যাত শ্রী রাম চন্দ্রের মঠ মন্দিরের কথা অনেক হল, এবারে চলুন একটু যাওয়া যাক একেবারে মাটির কাছে, সোঁদা গন্ধ যুক্ত জীবনের কাছে, ঘন জঙ্গলে। সেখানেও পারতে পারতে গ্রামের মেঠো পথে, ধূ ধূ নদীর বলু চরে বা গভীর আদিম শাল বনের জঙ্গলেও মিশে আছে রাম নাম।লৌকিক গল্পমালায়,সাধারণ মানুষের জীবন যাত্রায়, উদাসী সাধকের জপের মালায় খোঁজ পাওয়া যায় শ্রী রাম চন্দ্রের।

রামেশ্বর শিব মন্দির ও বাল্মীকির তপোবন—

বৃহত্তর মেদিনীপুরের অন্তর্গত আধুনা নব নির্মিত ঝাড়গ্রাম জেলার শাল জঙ্গলে আবৃত হল নয়াগ্রাম থানা। নয়াগ্রাম থেকে গোপীবল্লভপুর যাওয়ার পথে চাঁদাবিলা গ্রাম। এই চাঁদাবিলা পর্যন্ত বাসরাস্তা। এখান থেকে লাল মোরামে ঢাকা মেঠো পথ জঙ্গলের গা ঘেষে এগিয়ে গেছে সূবর্ণরেখার দিকে।সূবর্ণরেখার স্বর্ণ বালুর ধূ ধূ করা প্রান্তে একা দাঁড়িয়ে আছে তিরিশ ফুটের এক বিশাল শিব মন্দির, —রামেশ্বর মন্দির। মন্দিরটির নির্মান কাল, বা নির্মাণ প্রসঙ্গে কোন কথাই জানা যায় না। লোক মুখে প্রচলিত জনশ্রুতি রামায়ণের কাহিনি মিলিয়ে।

  পিতৃসত্য পালনের উদ্দেশ্য শ্রীরাম চন্দ্র পত্নী সীতা এবং প্রিয় ভ্রাতা লক্ষণের সাথে এই সুবর্ণরেখা তীরে গভীর জঙ্গলে বনবাসে এসেছেন। শিবরাত্রিতে শিবের অর্চনার জন্য সীতাদেবী সুবর্ণরেখার বালি দিয়ে দ্বাদশ শিবমূর্তি নিজ হাতে তৈরী করে পূজা শেষে নদীতে বিসর্জনের সময় দৈববাণী হয় যে এই নদীর চরেই শিব লিঙ্গ প্রতিষ্ঠা করতে হবে।শ্রীরাম চন্দ্র বিশ্বকর্মার সহায়তায় শিবের মন্দির তৈরী করেন এবং নিজে অর্চনা করেন। শ্রীরাম দ্বারা পূজিত শিব লিঙ্গটি রামেশ্বর শিব নামে পরিচিত।

  মন্দিরের সপ্তরথ শিখর দেউলটি ওড়িশা শিল্প রীতিতে নির্মিত, অনেকটা পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের মতো নির্মান কৌশল। মাকরা পাথরের তৈরী বিশাল এই মন্দির।গর্ভমন্দির, ভোগ মন্ডপ, নাট মন্দির সহ সমগ্র মন্দির। গর্ভগৃহে কোন জানলা নেই। তিনটি আঙ্গনের দরজা এমন ভাবে সমান্তরালে নির্মিত  যে সূর্যোদয় হলেই রবি কিরণে  শিবলিঙ্গটি আলোকিত হয়।

রামেশ্বর মন্দির থেকে জঙ্গল পথে তিন কিলোমিটার গেলেই বাল্মীকির তপোবন। শাল বনে সাত-আট ফুটের উঁইঢিপি, বহু প্রাচীন এক অনাড়ম্বর সমাধি মন্দির এবং ধিকি ধিকি করে সর্বক্ষণ জ্বলতে থাকা অগ্নিকুন্ড স্থানীয় লোধা সম্প্রদায়ের মানুষদের কাছে সাক্ষাৎ বাল্মীকির তপোবন। কয়েক শতাব্দী ধরে লোকমুখে প্রচলিত বাল্মীকির আশ্রম জঙ্গলের  নিজস্ব বিশ্বাস।

বহুকাল থেকেই সাধু সন্তদের ভীড় এই তপোবনে। খোলা আকাশের নীচে শিবের মন্দিরও আছে। আর আছে পুরনো মন্দিরে শ্রী রামচন্দ্র, সীতাদেবী, লক্ষণ আর মহর্ষি বাল্মীকির বিগ্রহ।

  স্থানীয় বাসিন্দারা মনে করেন এই তপোবনেই সীতাদেবী জমজ সন্তান লব ও কুশের জন্ম দেন। সেই স্মৃতি রক্ষার্থে আঁতুড় ঘরও তৈরী করা হয়েছে, লব-কুশের মূর্তিও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কিছুটা দূর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে জলধারা। জলধারার কিছুটা অংশ হরিদ্রাভ আর কিছুটা স্বচ্ছ। দুদিকে দুটি ভিন্ন রঙের জলধারাকে নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে জনশ্রুতি। অরণ্যবাসী স্থানীয় মানুষেরা মনে করেন সীতাদেবী জলধারার যেদিকটাতে হলুদ মেখে স্নান করতেন সেই দিকের জল হলুদ বর্ণের হয়ে গেছে। প্রকৃতপক্ষে, দস্তা জাতীয় কোন আকরিকের ওপর দিয়ে জলধারা বয়ে যাওয়ার জন্যই হয় তো এই হলুদ বর্ণ। পূণ্যকামী মানুষের কাছে এই হলুদ জল পবিত্র সোনা ঝরা জল। বহু মানুষ গভীর বিশ্বাসে এই জল সংগ্রহ করে নিয়ে যান।

প্রাচীন অনাড়ম্বর এক সমাধি, কোন ফলক নেই,শিলালিপি নেই। কিন্তু এই গভীর জঙ্গলে, যেখানে সভ্যতার গতি স্তব্ধ সেখানে মন যেন বিশ্বাস করতে চায় অরণ্যবাসী সহজ সরল মানুষগুলোর মতো, এই সমাধি মন্দিরটিই রামায়ণ রচয়িতা মহর্ষি বাল্মীকির সমাধি, এই লাল মাটির শাল বনের জঙ্গলেই কোন এক আদি শাল গাছের তলায় বসে মহর্ষি বাল্মীকি রচনা করেছিলেন আদি মহাকাব্য রামায়ণ।

Angira Datta Dandapat

About Angira Datta Dandapat

অঙ্গিরা দত্ত দন্ডপাট, জন্ম এবং বেড়ে ওঠা মেদিনীপুর শহরে। প্রাণীবিদ্যায় স্নাতকোত্তর এবং বিএড ডিগ্রি লাভ বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। প্রথাগত পড়াশুনা ইতিহাস এবং লোকসংস্কৃতি না হলেও, বিষয়গুলির প্রতি ভালোবাসা থেকে নিয়মনিষ্ঠ ইতিহাস এবং লোকসংস্কৃতি চর্চা শুরু। এছাড়া নিয়মিত ক্ষেত্রসমীক্ষা লেখকের অন্যতম পছন্দের বিষয়। ওঁর লেখা তথ্যনিষ্ঠ বহুল সমাদৃত ঐতিহাসিক কাহিনি সংকলন ‘শিলালেখ’ সিরিজ, রোমাঞ্চকর ঐতিহাসিক উপন্যাস ‘সংকটে গৌড়(সূচনা পর্ব)’ , 'লৌকিক জীবনের অলৌকিক আখ্যান' পাঠক সমাদৃত। লেখকের লেখায় ইতিহাস বাঙ্ময় হয়। সামান্য সময়ের মধ্যেই পাঠকসমাজে নিজের স্থান করে নিয়েছেন লেখনীর গুণে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *