Library

চৌষট্টি যোগিনী মন্দির, এক ভুলে যাওয়া ইতিহাস

চৌষট্টি যোগিনী মন্দির যাব।” 

“এরকম কোনো মন্দির এখানে নেই।” 

“আছে। হীরাপুরে। ভুবনেশ্বর থেকে আধ ঘন্টার পথ।”

“হীরাকুঁদ? সে তো অনেক দূর।”

“হীরাকুঁদ নয়। হীরাপুর। বালিয়ান্তার কাছে।”

ভুবনেশ্বরের মন্দিরগুলি ঘোরার পর ড্রাইভারের সাথে কথোপকথন। ড্রাইভার পুরীর ছেলে। তার জীবন কেটেছে পুরী কোনারক ভুবনেশ্বরে ট্যুরিস্টদের ঘুরিয়ে। কিন্তু হীরাপুরের নামটাই শোনা নেই তার। আমাদের কথায় ভরসা করতে না পেরে ভুবনেশ্বরে এক দেশোয়ালি ভাইয়ের দোকানে গেল। সে মুখের ওপর বলে দিল “আমি বালিয়ান্তার ছেলে। ওখানে এরকম কোনো মন্দির নেই।” শেষে গুগল ম্যাপে যখন মন্দিরের বিবরণ দেখানো হল, তখন তার চোখে বিরক্তির জায়গায় অকপট বিস্ময়। এভাবেই গাড়ি ছুটল ভুবনেশ্বর থেকে বালিয়ান্তা হীরাপুরের পথে; চৌষট্টি যোগিনীর দর্শনের আশায়। 

খ্রীষ্টীয় নবম শতক। “গান্ধার থেকে জলধি শেষ” পর্যন্ত পালসাম্রাজ্যের অধিপতি সম্রাট দেবপাল। তাঁর পরে মহেন্দ্রপাল। তাঁদের অধীনস্থ উৎকলে ভৌম বংশের শাসন শেষ হয়েছে। অথচ সোমবংশীদের রাজত্ব আরম্ভ হয় নি। গবেষক বিদ্যা দেহজিয়ার মতে এই সময়েই তান্ত্রিক মতাদর্শে অনুরাগী ভঞ্জ রাজবংশ নির্মাণ করেন চৌষট্টি যোগিনীর মন্দির। 

  বেলেপাথরের এই মন্দির দয়া নদীর মজে যাওয়া একটি শাখা ও একটি অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদের ধারে অবস্থিত। বাংলায় যেমন কানা ময়ূরাক্ষী, কানা দামোদর, অজয়ের উপনদীদের তীরে একের পর এক প্রাচীন তন্ত্রপীঠ গড়ে উঠেছিল, এখানেও দয়া নদীর তীরে সেভাবেই গড়ে উঠেছে যোগিনীপীঠ। নদীতটের বালিয়াড়ি সংলগ্ন অঞ্চল বলেই সম্ভবত বালিয়ান্তা নামটি এসেছে।

  যোগিনীগণ মাতৃশক্তি। তাঁরা জগতজননীর সহচরী এবং অভিন্ন তত্ত্বস্বরূপা। তবে শুধু এইটুকুই নয়। অতীতে মাতৃকার যে সমস্ত রূপ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল, অথচ পরে সাধনক্রম লুপ্ত হয়ে গিয়েছে, সেই সমস্ত সুপ্রাচীন রূপের ছায়াসম্পাত ঘটেছে যোগিনীদের মধ্যে। তার মধ্যে পক্ষীমুখী, পশুমুখী মাতৃকারা আছেন। আছেন সপ্তমাতৃকা, সন্তান কোলে মাতৃকারাও। এমন অনেক মাতৃকাও যোগিনীদের মধ্যে আছেন, পরবর্তী যুগে পৌরাণিক সাহিত্য যাঁদের রাক্ষসী, দানবী বলেছে। পূতনা, হিড়িম্বা, তারকা, জরা এঁরা এই পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ। ভবিষ্যতে যদি তন্ত্রের আজকের ধারা লুপ্ত হয়ে গিয়ে কোনো নতুন ধারা আত্মপ্রকাশ করে; দেখা যাবে আজকের প্রধান মাতৃশক্তি দুর্গা, কালী, তারা এঁরা তন্ত্রের সেই নতুন সাধনায় প্রধান মাতৃকার যোগিনী হয়ে পূজা পাচ্ছেন। 

  যোগিনীদের সংখ্যা ও নামের কোনো সীমা নেই। কখনও আট, কখনও চৌষট্টি, কখনও কোটি। মূলত আটের গুণিতকে তাঁদের মণ্ডল রচিত হয়ে আসছে খ্রীষ্টপূর্ব যুগ থেকে। মহাভারতের শল্যপর্বে এঁদের সংখ্যা ১৯২ (অর্থাত ৬৪x ৩)। খুব সম্ভবত সাতজন মাতৃকার কেন্দ্রে আদিজননী, এই আটজনের আদি মণ্ডলের অনুকরণে এই সংখ্যার প্রবর্তন। তার উপর আরোপিত হয়েছে সাঙ্খ্যের প্রকৃতির অষ্টতত্ত্ব, কুলকুণ্ডলিনীর গতির সংকেত। 

যে সময় হীরাপুরে এই যোগিনী মন্দির নির্মিত হয়, তখন বাংলা তন্ত্রের প্রধানতম ক্ষেত্র। অথচ এখানে কোনো যোগিনী মন্দির নেই। সম্ভবত তার কারণ এখানে মূল মাতৃকার সাধনাই সমস্ত পীঠে প্রচলিত। সেখানে প্রতিদিন পূজার সময় চৌষট্টি বা কোটি যোগিনীর পূজা হয়ে আসছে। আজও দুর্গাপূজার নবমীর দিন “দক্ষযজ্ঞবিনাশিনী, মহাঘোরা, কোটিযোগিনী পরিবৃতা ভদ্রকালী” রূপে মা দুর্গার পূজা হয়। তাই হয়তো আলাদা করে যোগিনী মন্দির নির্মাণ করার প্রয়োজন হয় নি। 

ভারতের অধিকাংশ যোগিনী মন্দির বৃত্তাকার। প্রবেশপথ সহ আকারটি মাতৃগর্ভের মতো। একে মাতৃকাচক্র বলা হতো। হীরাপুরের যোগিনী মন্দিরও বৃত্তাকার। বৃত্তের বাইরে আটজন কাত্যায়নী। তাঁরা সকলেই হাতে খড়্গ ও কপাল ধারণ করেন। শবমুণ্ডের উপর অধিষ্ঠান করেন। পদতলে শৃগালগণ বিচরণ করছে। পালযুগের শেষদিকে উড্ডিয়ানের তন্ত্রমার্গে বজ্রযোগিনী ও নৈরাত্মার এই বিশেষ রূপটিই আজকের কালীতত্ত্বের নির্মাণ করেছিল। 

বৃত্তের ভিতরের দেওয়ালে ষাটজন যোগিনী। সকলেরই বিচিত্র বাহন (কচ্ছপ, হরিণ, শব, ময়ূর, ইঁদুর প্রভৃতি)। এরপরে কেন্দ্রীয় বৃত্তে চারজন যোগিনী ও চারজন ভৈরব। সকলেই শবের উপর অধিষ্ঠান করছেন। এবং শবটি মৃতদেহ আর বর্তমান মা কালী মূর্তির পদতলের শবশিবের মাঝামাঝি পর্যায়ের বৈশিষ্ট্য বহন করছে। ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় কালীর বর্তমান রূপের উত্থান প্রসঙ্গে এই বৈশিষ্ট্যটি লক্ষ্য করেছিলেন। কেন্দ্রীয় বৃত্তের ভিতরে কোনো বিগ্রহ নেই। সম্ভবত বাক্য মনের অতীত জগতকারণ মাতৃকার নিরাকার তত্ত্বই এখানে প্রতিষ্ঠিত। 

এই মন্দির দীর্ঘদিন লোকচক্ষুর আড়ালে থাকার পর ১৯৫৩ সালে পুরাতাত্ত্বিক কেদারনাথ মহাপাত্র পুনরুদ্ধার করেন। এখন বিশেষ তিথিতে মাছ বলি হয়। আর নিত্যপূজার ব্যবস্থা আছে। তবে খোদ ওড়িশার সাধারণ মানুষই আজও এর অস্তিত্ব জানেন না। উৎকল যে কেবল জগন্নাথ আর কোনারক নয়, তার যে অত্যন্ত সমৃদ্ধ মাতৃপূজার ঐতিহ্য বিদ্যমান, সে বিষয়ে সচেতনা বাড়াতে সরকারের পদক্ষেপ অত্যন্ত প্রয়োজন। 

Dr. Raktim Mukherjee

About Dr. Raktim Mukherjee

পেশা: চিকিৎসক। নেশা: সাহিত্যচর্চা, ইতিহাস। বিশেষ করে বাঙালির ইতিহাসের একনিষ্ঠ পাঠক। চর্যা শারদীয়া সংখ্যায় প্রকাশিত উপন্যাস গৌড়বিক্রম।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *