তবাস্সুম

এক
হু হু করে ট্রেন ছুটে চলেছে, মনটা বড়ো বিক্ষিপ্ত।জানলার কাঁচের বাইরে সন্ধ্যা নামার মুহুর্তটা দুচোখ ভরে দেখছি। প্রতি সেকেন্ডের ভগ্নাংশে পাল্টে যাচ্ছে বাইরের ছবি, দিনের আলোর শেষ আবীরটুকু আকাশের বুকে পুরনো দিনের মলিন স্মৃতির মতো আবছা, যেতে যেতে রেশটুকু রেখে যাচ্ছে যেন লজ্জবতীর লালিমায়। সেটুকুও ক্ষণিকেই সন্ধ্যাদেবীর আঁচলের ছায়ায় চলে যাবে দৃষ্টি সীমার বাইরে।
দৃষ্টি সীমার বাইরে যাওয়া মানেই কি একেবারে মুছে যাওয়া? চোখের আড়ালে মানেই কি নেই হয়ে যাওয়া? সত্যিই কি মুছে যায় সব কিছু, মুঝে কোথায় যায়.. দেখার সীমার বাইরে না দেখার জগতে কি জমা হয় সব মুহূর্তগুলো… এলোমেলো চিন্তা করতে করতে কাঁচের বাইরে দেখি আঁধার নামছে, থোপা থোপা অন্ধকার দখল নিচ্ছে চরাচর জুড়ে। সন্ধ্যা নামার মুহূর্তটা ভারী অদ্ভুত, ক্লান্ত প্রকৃতি যেন ধীর পায়ে আলো-আঁধারির পথ বেয়ে রাতের দিকে এগিয়ে চলে। দু চোখ ভরে আলো-আঁধারির খেলা দেখতে দেখতে মনটা কোন কারণ ছাড়াই ভারী হয়ে যায়, জীবন যেন কোলাহল থেকে মুক্তি নিয়ে শান্তির কুলায় ফিরতে চায়।
ট্রেন বেশ লেট করেছে, প্রায় ছয় ঘন্টা। আর আধ ঘন্টার মধ্যেই মুঘলসরাই অধুনা দীনদয়াল উপাধ্যায় জংশন আসবে আশা করা যায়। আমার কোন তাড়া নেই, দূর দূরান্ত অব্দি বিস্তৃত রেল লাইন বরাবর যদি নিরুদ্দেশে যাত্রা করা যেত, বেশ হতো!
দুই
গৌরবর্ণ দীর্ঘকায় মানুষটি মুঘলসরাইতে আমার পাশের সীটের দখল নিয়েছেন। নাকে আসছে হালকা বিদেশী সুগন্ধীর সুবাস। বেশ রুচিশীল লোক বলতে হবে! টুকটাক কথাবার্তার মধ্যে দিয়ে জমে উঠল আলাপ। ভদ্রলোক প্রবাসী বাঙালী, এলাহাবাদের বাসিন্দা, কলেজে পড়ান। কিছু কিছু মানুষের কথা শুনতে ভালো লাগে, উনি ঠিক তেমন ধরনেরই। ট্রেনের গতির সাথে তাল মিলিয়ে কথা বার্তাও এগিয়ে চললো, বেশ জমে গেল আমার সাথে।
আমি আগ্রা যাচ্ছি শুনে উনি বললেন, “আপনি তাজমহল দেখতে যাচ্ছেন?”
আমি হালকা হেসে বললাম, “না না, তাজ দেখতে না, আমি প্রায়ই যাই, তবে ফাঁকতালে তাজ দর্শনও হয়ে যায় আর কি!”
ভদ্রলোক বললেন, “আপনি আগ্রা ভালোই চেনেন মনে হচ্ছে, পুরোনো আগ্রার অলি গলিতে ইতিহাস ঘুমিয়ে থাকে, লাল পাথরের জাফরির আলো আঁধারি বেয়ে কতটুকুই বা আমাদের নজরে পড়ে!”
আমি ঘাড় নেড়ে সহমত জানালাম।
একটু চুপ থেকে বললাম, “এই আলো-আঁধারির টানেই বারবার বেরিয়ে পড়ি, সুস্থির হতে দেয় না এই টান।”
ভদ্রলোক স্মিত হেসে বললেন, “যাকে টান দেবে আলো-আঁধারির রাজ্য, সে কি আর সুস্থির থাকতে পারে, এ যে অমোঘ আকর্ষণ, পথের টান, ঘরে কি আর মন টেকে!”
আমি একটু উত্তেজিত হয়ে বললাম, “ঠিক বলেছেন, ঘরে একেবারে মন টেকে না, প্রেম ভালোবাসা, আয়- উপার্জন সব কিছু বিষবৎ মনে হয়। বোঝা মনে হয় যেন জীবনটা।”
ভদ্রলোক আবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ” প্রেম ভালোবাসা আপনার বিষবৎ মনে হয়? “
আমি জোরের সাথেই বললাম, “নিশ্চয়ই মনে হয়। এসব গুলো জীবন পথের বাধা, পায়ের বেড়ি।”
ভদ্রলোক নির্নিমেষ চোখে চেয়ে আছেন আমার দিকে, আমি চিবিয়ে চিবিয়ে বললাম, “প্রেম আবার কি? ওসব হরমোনের কেরামতি আর বস্তাপচা একটা কনসেপ্ট, জীবনটাকে আবদ্ধ করে রাখার কৌশল”
এতোগুলো কথা বলে হাত বাড়ালাম পাশে রাখা জলের বোতলটার দিকে। ঢকঢক করে কিছুটা জল খেয়ে জানলার কাঁচের বাইরের দিকে তাকালাম।
নিজেরই খারাপ লাগছে, এভাবে ওনাকে না বললেই হয় তো… আসলে যা বুঝি সেটা গলা ফাটিয়ে বলার বদ অভ্যাসটা আমার আর গেলো না। ওনার দিকে তাকাতেও কেমন যেন লাগছে, অদ্ভুত এক আড়ষ্টতা আমাকে তাকাতে বাধা দিচ্ছে, এভাবে না বললেই হয় তো..
তিন
রাতের পর রাত আকাশের রঙ বদলানো দেখি, নক্ষত্রভরা আকাশের তলায় দাঁড়িয়ে অনুভব করি নিজের ক্ষুদ্রতা, এই বিশাল ব্যপ্তির কাছে ধুলিকণাসম আমি। গুনগুনিয়ে উঠি রবি ঠাকুরের গান,
ওই আকাশে আমার মুক্তি আলোয় আলোয়..
আসলেই কি আকাশেই মুক্তি? এই যে সব ছেড়ে বেরিয়ে পড়া, এটাও তো মুক্তি, নিজের মতো করে, নিজের শর্তে বাঁচা এটা কি মুক্তি নয়?… হকারের চায়ের হাঁকে চিন্তাসূত্র ছিড়ে যায়, সহযাত্রী ভদ্রলোক ডাক দেন চাওয়ালাকে, দুটো চা দিতে বলেন হকারকে। আমার দিকে চা এগিয়ে দিয়ে বলেন, “নিন শুরু করুন।”
বাইরে বেশ অন্ধকার, মাঝে মাঝে নাম না জানা স্টেশনের প্লাটফর্মের এক চিলতে আলো পেরিয়ে যাচ্ছে ট্রেন ঝড়ের বেগে, তারপরেই আবার অন্ধকার।
ভদ্রলোকই কথা শুরু করলেন, আমার দিকে ফিরে বললেন, ” শাহ লতীফের কথা শুনেছেন? “
আমি মাথা নেড়ে না বললাম।
উনি বললেন, “এই শাহ লতীফ জন্মেছিলেন সিন্ধু প্রদেশে হালা হাবেলি গ্রামে৷ শাহ লতীফ নাম লিখে গুগলে সার্চ করলেই ওনার জন্মসন,তারিখে, উরষের বিবরণ সব পেয়ে যাবেন, কিন্তু এখন ওনার একটি গল্প বলি শুনুন।”
আমি বুঝলাম, যে কোন কারণেই হোক পূর্ণ কুম্ভে টোকা লেগেছে, এবারে জল উছলে পড়বেই।
আমি সানন্দে বললাম, ” বলুন আপনি শাহ লতীফের কাহিনী। “
শুরু করলেন কাহিনী, শাহ লতীফ তখন সাধনার মধ্য গগনে, অন্তর রাগ অনুরাগে রঞ্জিত। আসে পাশে বেশ প্রভাবও বিস্তার হয়েছে, মুরিদের(শিষ্য) সংখ্যা ও বেড়েছে সাথে সাথে। একদিন কয়েকজন মুরিদ হন্তদন্ত হয়ে এসে বললো, বাবা, ঘোর অনাচার হয়েছে, আপনি এর বিচার করুন। শাহজী তো অবাক, কি হয়েছে? কিসের বিচার তিনি করবেন? মুরিদদের মুখে শুনলেন পাশের গাঁয়ের এক উচ্চবংশীয়া নারী কুলের মুখে চুনকালি দিয়ে এক পুরুষের সাথে পালিয়ে গেছে। সমাজে এ অনাচার চলবে না, তাই দলবেঁধে মুরিদেরা এসেছে তাদের মুর্শিদের কাছে বিচার চাইতে।
শাহজী এই ঘটনাটি শুনে কয়েক মুহূর্ত যেন আত্মবিস্মৃত হলেন, নিজের মনেই বললেন,বিচার, হ্যা, বিচার চাই.. এর বিচার চাই। তারপরেই যেন জেগে উঠলেন, মুরিদের দিকে ফিরে বললেন, মেয়েটির কী সাহস! মেয়েটির কী টান! নিশ্চিত আরামের জীবন ছেড়ে প্রেমের টানে সে চলে গেল তার প্রেমিকের সঙ্গে! তার জন্য আমি দোয়া করছি, সে যেন আপন প্রেমের পথে সফলকাম হয়।
একটি শক্তিহীনা, সামর্থ্যহীনা মেয়ে প্রেমের দায়ে প্রিয়তমের সাথে অন্ধকার পথে এসে দাঁড়ালো,কজন পারে প্রেমের দায়ে অনিশ্চিত পথে ঝাঁপ দিতে? আল্লাহকে ভালোবেসে আরামের জীবন ত্যাগ করে কয়জন? প্রেম তো একই, নারী পুরুষের প্রেমও যা আর ইশক্ ই হাকিকি, সর্বশক্তিমানের প্রতি প্রেমও তা।
ভদ্রলোক চুপ করে আমার দিকে তাকালেন, আমি দ্বিধা জড়ানো কন্ঠে বললাম, “দুটো প্রেমই এক? “
উনি স্মিত হেসে বললেন, “প্রেম তো একই, প্রেমের আবার রকম ফের আছে নাকি!”
চার
মনের মধ্যে কেমন যেন একটা কাঁটা ফুটছে খচ খচ করে, অনেক কিছু যেন বলার অনেক কিছু যেন শোনার আছে। কিন্তু কি বলবো, কি শুনতে চাইছি কিছুই বুঝতে পারছি না। থেকে থেকে গলার কাছটাতে দলা পাকিয়ে আসছে। আপাদমস্তক ঢাকা নিয়ে শুয়ে পড়েছি, হু হু করে ট্রেন ছুটছে, আর কিছুক্ষণ পরেই এলাহাবাদ আসছে…। চোখটা একটু লেগে গিয়েছিল, হঠাৎ ভদ্রলোকের গলা,
“শুনছেন?”
আমি তাড়াহুড়ো করে উঠে বসতে গেলাম, উনি নিরস্ত করে বললেন, “উঠতে হবে না, আপনি ঘুমোন, আমার স্টেশন এসে গেল, এবার নামি।”
আমি ঘাড়টা উঁচু করে বললাম, “আবার দেখা হবে।” উনি প্রত্যুত্তরে স্মিত হেসে ব্যগটা নিয়ে এগিয়ে গেলেন।
এই যা! নামটাই তো জানা হয়নি ওনার, তবে হাসিটা মনে থেকে যাবে, কি বলে যেন এই হাসিটাকে… তবস্সুম।